বৃহস্পতিবার, ১৫ মে ২০২৫, ০৯:২৯ অপরাহ্ন
এম এইচ ফাহাদ-বিশেষ প্রতিনিধি।। পদ্মার ইলিশ দেশসেরা, এত দিন এমন ধারণাই মানুষের মুখে মুখে প্রচার পেয়ে আসছে। এবার গবেষণা করে একদল বিজ্ঞানী বলেছেন, দেশের ইলিশের বেশির ভাগই মেঘনা থেকে আসে। স্বাদে ও পুষ্টিতে এই মোহনার মাছ শুধু দেশের মধ্যেই নয়, বিশ্বসেরা। আর আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে পুষ্টি ও স্বাদে সেরা ইলিশগুলো ধরা পড়ে।
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় মহাসাগর গবেষণা সংস্থা (নোয়া) থেকে পাওয়া ১৯৯৮ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে এসব কথা জানাচ্ছেন দেশের একদল গবেষক। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেস এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওশানোগ্রাফি বিভাগের চারজন গবেষক যৌথভাবে ওই গবেষণা করেছেন।
চলতি বছরের মার্চে যুক্তরাষ্ট্রের নেচার পাবলিশিং গ্রুপের বিজ্ঞান সাময়িকী সায়েন্স রিপোর্টস–এ গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে। ‘প্রাইমারি প্রোডাক্টিভিটি কানেক্টস হিলশা ফিশারিজ ইন বে অব বেঙ্গল’ শীর্ষক ওই গবেষণা প্রতিবেদনে ইলিশের স্বাদ ও ওজন বৃদ্ধির কিছু কারণ তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, সাধারণত সমুদ্রে থাকা অবস্থায় ইলিশের ওজন ও স্বাদ কিছুটা কম থাকে। কারণ, সেখানে তার জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য উদ্ভিদ ও প্রাণিকণা কম থাকে। নদী ও মোহনায় তা বেশি থাকে। বিশেষ করে মেঘনা অববাহিকায় এর উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি। সাগর থেকে নদীতে আসার সময় ইলিশ স্রোতের উল্টো দিকে ঘণ্টায় ৭১ কিলোমিটার পর্যন্ত সাঁতার কাটে। যাওয়ার পথে শক্তি অর্জনের খাবারও গ্রহণ করে। মেঘনা অববাহিকায় উদ্ভিদকণা বেশি থাকায় ইলিশ তা খায় এবং এতে তার শরীরে প্রচুর ফ্যাটি অ্যাসিড ও ওমেগা থ্রি তৈরি হয়। ওই দুটি উপাদান একই সঙ্গে খুবই পুষ্টিকর ও সুস্বাদু। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, ভাইরাসের আক্রমণ প্রতিরোধ করাসহ নানা কাজে ওই দুই উপাদান মানুষের জন্য খুবই উপকারী।
গবেষণাটিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ইলিশের উৎপাদনের মাত্র ২ শতাংশ আসে পদ্মা থেকে। তাও সেগুলো আকৃতিতে ছোট হয়। বড় ও স্বাদের ইলিশের বেশির ভাগই পাওয়া যায় মেঘনা অববাহিকায়।
গবেষণায় সুপারিশ হিসেবে মেঘনা অববাহিকায় জাটকা ধরা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ, দূষণ কমানো এবং বেহুন্দি জাল বন্ধ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, বাংলাদেশে যে পরিমাণ ইলিশ ধরা পড়ে, তার আর্থিক মূল্য দুই বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশের প্রায় পাঁচ লাখ জেলে ওই মাছ ধরার ওপরে জীবিকা চালায়। আর বাজারজাত করা মিলিয়ে প্রায় ২৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান এই মাছের ওপর নির্ভরশীল।
গবেষণায় সুপারিশ হিসেবে মেঘনা অববাহিকায় জাটকা ধরা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ, দূষণ কমানো এবং বেহুন্দি জাল বন্ধ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, বাংলাদেশে যে পরিমাণ ইলিশ ধরা পড়ে, তার আর্থিক মূল্য দুই বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশের প্রায় পাঁচ লাখ জেলে ওই মাছ ধরার ওপরে জীবিকা চালায়। আর বাজারজাত করা মিলিয়ে প্রায় ২৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান এই মাছের ওপর নির্ভরশীল।
গবেষণাটিতে বঙ্গোপসাগরের ৩৬ লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকায় উদ্ভিদকণা ও প্রাণিকণার পরিমাণ বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
ইলিশ গবেষক ও আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিশ-বাংলাদেশের ইকো ফিশ প্রকল্পের দলনেতা অধ্যাপক আবদুল ওহাব বলেন, এই গবেষণার মাধ্যমে দেশের ইলিশ সম্পর্কে যেসব তথ্য উঠে এসেছে, তা সামনের দিনে ইলিশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তবে এখান থেকে পাওয়া তথ্য থেকে আমাদের এই শিক্ষা নিতে হবে যে দেশের সমুদ্র উপকূলে ইলিশ ধরার ক্ষেত্রে আমাদের ছোট সামুদ্রিক যানগুলোকেই অনুমতি দিতে হবে।
প্রজনন মৌসুমের জন্য ১৪ অক্টোবর থেকে ৪ নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে ইলিশ ধরা বন্ধ থাকছে।
জীববিজ্ঞানে সাধারণভাবে প্রচলিত আছে, বড় মাছ ছোট মাছকে খায়। কিন্তু গবেষণাটিতে দেখা গেছে, মাছের রাজার খাদ্যতালিকার ৯৭ থেকে ৯৮ শতাংশই উদ্ভিদকণা। মেঘনা অববাহিকার পরই ওই খাবার সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে মিয়ানমারের ইরাবতী মোহনায়। এরপর যথাক্রমে মিয়ানমারের ইরাবতী অববাহিকা, ভারতের দক্ষিণ উপকূলের নদ-নদী, বাংলাদেশ-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড উপকূলসংলগ্ন এলাকাটি রয়েছে। আর গভীর সমুদ্রে ইলিশের খাবারের পরিমাণ সবচেয়ে কম। মেঘনায় উদ্ভিদকণা বেশি হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে হিমালয় থেকে সৃষ্টি হওয়া গঙ্গা ও তিব্বত থেকে ব্রহ্মপুত্র দিয়ে সারা বছরই বিপুল পরিমাণ উদ্ভিদকণা ভেসে আসে। তা মেঘনা দিয়ে বঙ্গোপসাগরে যায়। ইলিশের দল তাই মেঘনার মোহনায় ওই খাবারের জন্য বছরের বড় সময়জুড়ে ঘোরাফেরা করে। এমনকি তারা বাংলাদেশ উপকূলের ২৫০ কিলোমিটারের বাইরে খুব বেশি যায় না। কারণ, এর পরে ইলিশের জন্য প্রয়োজনীয় খাবার খুব একটা নেই।
জানতে চাইলে গবেষক দলের সদস্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেসের অধ্যাপক শাহাদাত হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, হিমালয় থেকে মেঘনা অববাহিকা হয়ে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত যে এলাকাটি রয়েছে, তাতে উদ্ভিদকণার অভাব নেই। অদূর ভবিষ্যতেও অভাব হবে না। ওই খাদ্যগুলো ইলিশের বেঁচে থাকা ও বড় হওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রাখে।
গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, মূলত দুটি মৌসুমে ইলিশের খাবারের প্রাচুর্য বেশি দেখা গেছে। এর মধ্যে আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে ৮০ শতাংশ ইলিশ ধরা পড়ে। বাকি সময়টা জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত। এই সময়ে জাটকা ইলিশ বড় হয়।